জুনোসিস কী? বাঁচবেন কীভাবে?

জুনোসিস কী? বাঁচবেন কীভাবে?  

Zoonosis

জানাচ্ছেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর ডাঃ জ্যোর্তিময় পাল।

মানুষ ছাড়া অন্যান্য যে কোনও প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের শরীরে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ফাঙ্গাস বাসা বাধলে জুনোসিস ডিজিস বলা হয়। এক্ষেত্রে পশু, পাখি, পতঙ্গ বা সরীসৃপের শরীর থেকে বিভিন্ন উপায়ে রোগ জীবাণু মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়ে থাকে।
সারা পৃথিবীতে যত ধরনের সংক্রামক রোগ রয়েছে তার ৬০ শতাংশই কোনও না কোনও সময়ে অন্যান্য প্রাণীর শরীর থেকেই মানুষের মধ্যে এসেছিল। তবে প্রাণীটির দেহে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে এক প্রকার ইমিউনিটি থাকে। অথচ সেই জীবাণু কোনওক্রমে মানুষের দেহে প্রবেশ করলেই সমস্যা বাধায়। অচেনা জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে অসুখ জটিল দিকে মোড় নিতে পারে। নোভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনই হয়েছে। সদ্য আবিষ্কৃত এই জীবাণুর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। রোগ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।
জুনোসিস ছড়ায় কীভাবে?
যে প্রাণীর দেহে জীবাণুটি থাকে তাকে বলে উৎস বা রিজর্ভর। সেই প্রাণী থেকে সরাসরি রোগ জীবাণু মানুষের শরীরে পৌঁছে যেতে পারে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে র‌্যাবিস ভাইরাসের কথা বলা যায়।
কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর দেহে থাকে র‌্যাবিস ভাইরাস। এবার সেই প্রাণী মানুষকে কামড়ালে মানুষের শরীরে পৌঁছে যায় র‌্যাবিস। এই বিশেষ ভাইরাসটির ক্ষেত্রে প্রতিবার সরাসরি রিজর্ভর-এর শরীর থেকেই মানুষের দেহে জীবাণু পৌঁছয়।
আবার অনেক সময় জীবাণু প্রাথমিক পর্যায়ে রিজর্ভর থেকে সরাসরি মানুষের শরীরে পৌঁছয়। তারপর মানুষ থেকে মানুষে সেই জীবাণু ছড়াতে থাকে। এইচআইভি রোগটি এমনই একটি রোগ। প্রাথমিকভাবে বাঁদর, শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছিল এইচআইভি। এরপর আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে ভাইরাসটি অন্য মানুষে ছড়িয়েছে।
এছাড়াও অনেকসময় রিজর্ভর থেকে বাহকের (ভেক্টর) মাধ্যমে জীবাণু মানুষের শরীরে পৌঁছয়। এক্ষেত্রে ডেঙ্গুর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। উট, ছাগল, খরগোশ ইত্যাদি প্রাণীর শরীরে প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস ছিল। এডিস ইজিপ্টাই মশা সেই প্রাণীগুলিকে কামড়ানোর ফলে মশার শরীরে এই ভাইরাসটি চলে আসে।
এরপর সংক্রামিত এডিস ইজিপ্টাই মশা কোনও মানুষকে কামড়ালে তাঁর শরীরে ডেঙ্গু জীবাণু ঢোকে। পরবর্তী সময়ে মশার মাধ্যমে সংক্রামিত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে।
জুনোসিস বাড়ছে
শেষ ২০ বছরে আবিষ্কৃত হওয়া সংক্রামক রোগগুলির সিংহভাগই জুনোসিস। তাই গোটা পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে জুনোসিস অন্যতম মাথা ব্যথার কারণ। জুনোসিসের এই বাড়বাড়ন্তের অন্যতম কারণগুলি হল— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্যাপক হারে গাছ কেটে নগরায়ণ, শিল্পায়ন চলেছে। ফলে মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর সংস্পর্শে আসার সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে  খুব দ্রুত গোটা পৃথিবীতে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। ফলে মশা সহ অন্যান্য রোগ বাহকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
  •  পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের পেট ভরাতে প্রাণিজ খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে অসংখ্য মানুষ প্রাণিজ খাদ্যদ্রব্যের পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এই মানুষগুলি সরাসরি বিভিন্ন প্রাণীর সংস্পর্শে এসে নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
  •  বিশ্বের পরিবহণ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন বিমানে চেপে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যাওয়া সম্ভব।
তাই খুব কম সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট জীবাণুতে আক্রান্ত ব্যক্তি এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছে সেখানকার মানুষকে সংক্রামিত করছে। আবার অনেকসময় বিমানে চেপে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে সংক্রামিত মশা, মাছির মতো রোগের বাহকও।
প্রতিরোধ কীভাবে?
১. প্রকৃতির প্রতি মানুষকে আরও যত্নবান হতে হবে। আবহাওয়া পরিবর্তন রোখার চেষ্টা করা দরকার।
২. মশা, মাছির মতো রোগের বাহকগুলির বাড়বাড়ন্ত কমাতে হবে।
৩. প্রত্যেককেই রোগ সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত হাত ধোওয়া, অকারণে চোখ-নাকে-মুখে হাত না দেওয়া, হাঁচি-কাশি হলে মুখে রুমাল দেওয়া ইত্যাদি সতর্কতা নিতে হবে। সমস্যা বাড়লে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া চাই।
৪. আরও গবেষণা চালিয়ে নতুন ওষুধ এবং টিকা আনতে হবে।

Post a Comment

0 Comments